
গাজীপুরে ভয়াবহ হারে বেড়ে যাচ্ছে বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা। সমাজ বিশ্লেষকদের মতে, পারিবারিক অশান্তি, যৌতুক প্রথা, মাদকাসক্তি, পরকীয়া এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাবই এই বিপর্যয়ের মূল কারণ। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গাজীপুরে প্রতিদিন গড়ে ৩০টি সংসার ভাঙছে—যা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি।
বিবাহবিচ্ছেদের আবেদনকারীদের মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সালিশি আদালত ও কাজি অফিস সূত্রে জানা যায়, নারীরা তালাকের আবেদনে উল্লেখ করছেন স্বামীর ভরণপোষণে অক্ষমতা, যৌতুকের চাপ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং মনের অমিলকে প্রধান কারণ হিসেবে। অনেকে অভিযোগ করছেন, নিজেদের উপার্জিত টাকায় স্বামীর ভাগ বসানো, দায়িত্বহীনতা ও প্রতারণা তাদের সম্পর্ককে ধ্বংস করেছে।
বিবাহবিচ্ছেদের নেপথ্যে রয়েছে হৃদয়বিদারক গল্পও। যেমন আঁখি আক্তার (ছদ্মনাম) জানালেন, বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই জানতে পারেন তার স্বামী ইয়াবায় আসক্ত। প্রতিদিন গভীর রাতে বাসায় ফিরে অকারণে নির্যাতন করতেন তিনি। শেষ পর্যন্ত অসহ্য নির্যাতনের শিকার হয়ে আঁখি বাবার বাড়িতে ফিরে তালাকের সিদ্ধান্ত নেন। অন্যদিকে শহরবানু (ছদ্মনাম) বছরের পর বছর সহ্য করেছেন স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির যৌতুকের চাপ। একসময় নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে তিনিও বিচ্ছেদের পথ বেছে নেন।
পরকীয়া এখন গাজীপুরে বিবাহবিচ্ছেদের আরেকটি বড় কারণ। হাফসা খাতুন (ছদ্মনাম) নিয়মিত অন্য এক পুরুষের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলতেন। একদিন হাতে-নাতে ধরা পড়ে গেলে স্বামী তাকে তালাক দেন। সমাজ বিশ্লেষকদের মতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সহজলভ্যতা, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অতিরিক্ত ব্যবহার এবং গোপন সম্পর্কের প্রসার দাম্পত্য জীবনের স্থিতি নষ্ট করছে।
এছাড়া গাজীপুরের শিল্পাঞ্চলভিত্তিক জীবনযাত্রাও পারিবারিক অস্থিরতার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় পাঁচ হাজার শিল্পকারখানায় কর্মরত হাজারো নারী-পুরুষ পরিচয়ের সূত্র ধরে তথাকথিত বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্থানীয় প্রভাবশালীদের মাধ্যমে বয়স জালিয়াতি করে নাবালিকা মেয়েদের বিয়ের ঘটনাও ঘটে। অনেকে “কন্ট্রাক্ট বিয়ে” করে একই ছাদের নিচে বসবাস করেন, কিন্তু সম্পর্ক ভাঙলে সেই বিয়ের কোনো রেকর্ড খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে নারীরা আইনি সুরক্ষা ও সামাজিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হন। অনেকে আবার পরকীয়ার টানে স্বামীর সঞ্চিত অর্থ ও গয়না নিয়ে পালিয়ে যান অন্য কারও সঙ্গে। এমনকি বৈধ স্বামীর সন্তানের ভ্রূণ নষ্ট করার ঘটনাও ঘটছে নিয়মিত।
গাজীপুর জেলা রেজিস্ট্রার অফিসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে ১৪ হাজার ৮০টি বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে, আর একই সময়ে বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে ৭ হাজার ৮৪৩টি। অর্থাৎ বিয়ের অর্ধেকেরও বেশি শেষ হয়েছে বিচ্ছেদে, যা সামাজিকভাবে অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
পিয়ার আলী কলেজের সমাজকল্যাণ বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর শেখ কামরুন্নাহার বলেন, সম্পর্কের যত্ন ও ভালোবাসার অভাব, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, বিশ্বায়নের প্রভাব এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় আজ বিবাহবিচ্ছেদের মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার মতে, আয়-ব্যয়ের পার্থক্য, পারস্পরিক সময়ের অভাব এবং পারিবারিক চাপ দাম্পত্য সম্পর্কে ফাটল ধরাচ্ছে।
ভাষাশহীদ কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মুকুল কুমার মল্লিক বলেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সহানুভূতির অভাব, জীবনের ধারা ও চিন্তাধারার অমিল, পারস্পরিক সময় না দেওয়া এবং অর্থনৈতিক চাপে এখন বিচ্ছেদের হার বেড়েছে ভয়াবহভাবে। এর প্রভাব পড়ছে সন্তানদের মানসিক বিকাশ ও সমাজের স্থিতিশীলতার ওপর।
গাজীপুর জেলা পুলিশ সুপার ড. মো. যাবের সাদেক বলেন, গাজীপুর একটি বৃহৎ শিল্পাঞ্চল। এখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ কাজ করতে আসেন। অনেকে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই শ্রমিক হিসেবে কর্মরত থাকেন। সময়ের অভাব, ক্লান্তি ও পরস্পরের প্রতি অবহেলা থেকে সৃষ্টি হয় দ্বন্দ্ব, যা শেষ পর্যন্ত তালাকে গিয়ে ঠেকে। তিনি বলেন, মাদকাসক্তি, বেকারত্ব ও আর্থিক নির্ভরতার সমস্যাও অনেক ক্ষেত্রে সংসার ভাঙার পেছনে ভূমিকা রাখে। এর ফলে শুধু তালাক নয়, অনেক সময় খুন ও আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটে।
গাজীপুরের এই বিবাহবিচ্ছেদের পরিসংখ্যান কেবল সংখ্যা নয়, এটি এক সামাজিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাবে প্রতিদিন ভেঙে যাচ্ছে ৩০টি পরিবার, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সন্তানদের মানসিক জগৎ, ভেঙে পড়ছে সামাজিক মূল্যবোধের ভিত্তি। সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, এই প্রবণতা রোধে এখনই প্রয়োজন পরিবারভিত্তিক মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও আইনি কাঠামো শক্ত করা—না হলে গাজীপুর হয়ে উঠবে ভালোবাসাহীন সম্পর্কের এক ভয়াবহ নগরী।