Date: October 18, 2025

দৈনিক দেশেরপত্র

collapse
...
Home / বিশেষ নিবন্ধ / পাক-আফগান সংঘাত: দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে নতুন সংঘাতের বার্তা - দৈনিক দেশেরপত্র - মানবতার কল্যাণে সত্যের প্রকাশ

পাক-আফগান সংঘাত: দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে নতুন সংঘাতের বার্তা

October 12, 2025 10:02:22 AM   শাহাদৎ হোসেন
পাক-আফগান সংঘাত: দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে নতুন সংঘাতের বার্তা

দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্র যেন নতুন করে আঁকা হচ্ছে ষড়যন্ত্র আর সংঘাতের কালি দিয়ে। এর কেন্দ্রে রয়েছে একসময়ের মিত্র পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। সম্প্রতি আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে পাকিস্তানের বিমান হামলাকে অনেকেই এই উত্তেজনার চূড়ান্ত মুহূর্ত হিসেবে দেখছেন। কিন্তু এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি)-এর দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ইসলামাবাদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙারই প্রতিফলন। আর এই সামরিক উত্তেজনার পাশেই চলছে কূটনীতির এক নাটকীয় খেলা, যেখানে পাকিস্তানের চিরশত্রু ভারতের সঙ্গে আফগান তালেবানের ক্রমবর্ধমান নৈকট্য এই সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে।

অনেকেই কাবুলে পাকিস্তানের বিমান হামলাকে টিটিপি’র কোনো হামলার জবাবে পাল্টা আক্রমণ হিসেবে দেখছেন, যা সত্যের অপলাপ মাত্র। বাস্তবতা হলো, টিটিপি দীর্ঘদিন ধরেই পাকিস্তানে, বিশেষ করে খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালিয়ে আসছে। ২০২১ সালে আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর থেকে টিটিপি-এর তৎপরতা শুধু বাড়েনি, তাদের দুঃসাহসও বেড়েছে কয়েক গুণ। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, ২০২৫ সালের প্রথম কয়েক মাসের সহিংসতার মাত্রা পুরো ২০২৪ সালকে ছাড়িয়ে গেছে।

ইসলামাবাদের বিমান হামলার ঠিক আগের ঘটনাপ্রবাহ এই প্রেক্ষাপটকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। হামলার মাত্র একদিন আগেই ওরাকজাই জেলায় টিটিপি’র অতর্কিত হামলায় ১১ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। পাকিস্তান বারবার অভিযোগ করে আসছে, আফগান তালেবান তাদের দেশের মাটিতে টিটিপি-কে নিরাপদ আশ্রয় দিচ্ছে। সেখান থেকেই পাকিস্তানে হামলা চালানো হচ্ছে। যদিও তালেবান সরকার বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

লাগাতার হামলায় অতিষ্ট হয়ে এবং কাবুলের নিষ্ক্রিয়তায় হতাশ হয়ে পাকিস্তান অবশেষে চূড়ান্ত পদক্ষেপটি নেয়। গত বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর, ২০২৫) রাতে পাকিস্তানের বিমানবাহিনী কাবুলের কেন্দ্রে টিটিপি প্রধান নূর ওয়ালি মেসুদকে লক্ষ্য করে হামলা চালায়। তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত না হলেও, টিটিপি-এর দুজন সিনিয়র নেতার নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এই হামলা ছিল আফগান তালেবানের জন্য একটি পরিষ্কার এবং কঠোর বার্তা: পাকিস্তান তার জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে কোনো আপস করবে না এবং প্রয়োজনে সীমান্ত অতিক্রম করতেও পিছপা হবে না।

এই ক্রমবর্ধমান শত্রুতার আবহের মধ্যেই ভূ-রাজনীতির দাবা বোর্ডে নতুন এক চাল দেওয়া হয়েছে, যা ইসলামাবাদকে আরও কোণঠাসা করে ফেলতে পারে। আর তা হলো ভারতের সঙ্গে আফগান তালেবানের সম্পর্কের উন্নতি। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর ভারত যে দূরত্ব বজায় রাখার নীতি নিয়েছিল, তা থেকে তারা ক্রমশ সরে আসছে।

এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সাম্প্রতিক ভারত সফর। জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা সত্ত্বেও বিশেষ ছাড়পত্র নিয়ে হওয়া এই সফরটি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠকে কাবুলে ভারতের মিশনকে দূতাবাসের মর্যাদায় উন্নীত করার মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসে।

ভারতের মাটিতে বসেই মুত্তাকি একদিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, অন্যদিকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাগরাম বিমানঘাঁটি ফেরত চাওয়ার দাবিকে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, আফগানিস্তানের মাটিতে কোনো বিদেশি শক্তির নিয়ন্ত্রণ চলবে না। চিরশত্রু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য ভারতের মাটিকে বেছে নেওয়া তালেবানের এই পদক্ষেপ আঞ্চলিক রাজনীতিতে তাদের নতুন আত্মবিশ্বাসেরই জানান দেয়। যদিও ভারত এখনো তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি, তথাপিও এই সফর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায়ের দরজা খুলে দিয়েছে।

সব মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়া এক জটিল ও অস্থিতিশীল ভবিষ্যতের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। একদিকে পাকিস্তান তার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আর বৈরী পশ্চিম সীমান্ত নিয়ে দিশেহারা। অন্যদিকে, আফগান তালেবান আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য এক কঠিন কূটনৈতিক যুদ্ধে নেমেছে।

এই খেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চালটি হলো ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক, যা পাকিস্তানকে কৌশলগতভাবে বিচ্ছিন্ন করার ক্ষমতা রাখে। কাবুল ও ডেরা ইসমাইল খানের ঘটনাগুলো তাই আর নিছক সীমান্ত সংঘাত নয়; বরং এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রে এক বড় ধরনের পালাবদলের ইঙ্গিত বহন করে।