
গাজার ধ্বংসস্তূপ আর লাশের মিছিলের ওপর দাঁড়িয়ে প্রায় আট দশক ধরে এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে চলেছে ফিলিস্তিন। ২০২৩ সালের অক্টোবরে এই সংঘাত নতুন মাত্রা পাওয়ার পর থেকে ইসরায়েলের আগ্রাসন গাজাকে এক চরম মানবিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এমন ভয়াবহ এক বাস্তবতায় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্যোগে একটি ২০ দফা শান্তি প্রস্তাব সামনে এসেছে, যা নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। এই প্রশ্নটিই আজ সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে এই প্রস্তাব কি সত্যিই শান্তির দূত, নাকি এর আড়ালে লুকিয়ে আছে গাজাকে চিরতরে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার এক গভীর নীলনকশা?
হোয়াইট হাউসে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে পাশে নিয়ে ট্রাম্প এই পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এতে যুদ্ধবিরতি, জিম্মি ও বন্দি বিনিময় এবং হামাসের নিরস্ত্রীকরণের মতো আকর্ষণীয় প্রস্তাবনা রয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা এর গভীরে তাকাতে গিয়ে বেশ কিছু উদ্বেগজনক দিক খুঁজে পেয়েছেন। তাদের মতে, এই প্রস্তাবের পরতে পরতে রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি এবং এটি শান্তির মোড়কে এক জটিল ভূ-রাজনৈতিক মায়াজাল ছাড়া আর কিছুই নয়। ট্রাম্পের ২০ দফার বেশ কয়েকটি ধারা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে এর পেছনের উদ্দেশ্য নিয়ে কঠিন প্রশ্ন ওঠে।
রাজনৈতিক অধিকারের বিনিময়ে অর্থনৈতিক প্রলোভন: প্রস্তাবের প্রথম দুটি ধারাতেই এর মূল উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে যায়, যা হলো রাজনৈতিক অধিকারকে অর্থনৈতিক প্রলোভনের আড়ালে চাপা দেওয়া। প্রথমত, 'গাজাকে চরমপন্থা ও সন্ত্রাসমুক্ত অঞ্চল করা হবে' এই ঘোষণার মাধ্যমে একটি বিপজ্জনক ফাঁদ পাতা হয়েছে।
'চরমপন্থা' এবং 'সন্ত্রাস' শব্দগুলোর কোনো নিরপেক্ষ সংজ্ঞা না থাকায়, এটি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের জন্য করা যেকোনো প্রতিরোধ আন্দোলনকেই 'সন্ত্রাস' আখ্যা দেওয়ার অবাধ সুযোগ করে দেবে। এর সঙ্গে দ্বিতীয়ত, 'গাজাবাসীর কল্যাণে উন্নয়ন করা হবে' এই প্রতিশ্রুতি জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা বিশ্লেষকদের মতে একটি ক্লাসিক 'অর্থনৈতিক শান্তির' ফাঁদ। এর মাধ্যমে একটি স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হচ্ছে: রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা এবং প্রতিরোধের অধিকার বিসর্জন দিলেই কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়ন মিলবে। এই দুটি ধারা একত্রে ফিলিস্তিনিদের একটি পরাধীন কিন্তু সচ্ছল জনগোষ্ঠীতে পরিণত করার নীলনকশা তৈরি করে, যাতে তারা তাদের ভূমি ও সার্বভৌমত্বের মূল দাবি ভুলে যায়।
'বোর্ড অব পিস' ঔপনিবেশিকতার নতুন রূপ: এই নীলনকশার সবচেয়ে বিতর্কিত দিকটি হলো গাজার ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা। প্রস্তাবের ৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, গাজার শাসনভার একটি অরাজনৈতিক ফিলিস্তিনি কমিটির হাতে থাকবে, যা 'বোর্ড অব পিস' নামক এক আন্তর্জাতিক কমিটির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে। এই বোর্ডের প্রধান হবেন স্বয়ং ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং এতে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের মতো ব্যক্তিত্বরাও থাকবেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটি ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার সামিল। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা এই বোর্ডকে "ঔপনিবেশিক অনুশীলনের দুঃখজনকভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়" বলে কঠোর সমালোচনা করেছেন। এই কর্তৃত্ববাদী কাঠামো ফিলিস্তিনিদের নিজেদের নেতা নির্বাচনের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেবে এবং গাজাকে একটি আন্তর্জাতিক পুতুল রাজ্যে পরিণত করবে। হামাসের নিরস্ত্রীকরণ আত্মসমর্পণের নামান্তর: প্রস্তাবটি হামাসসহ ফিলিস্তিনের সকল প্রতিরোধ শক্তিকে নির্মূল করার একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়। ৬ নম্বর ধারায় হামাস সদস্যদের ক্ষমা ও নির্বাসনের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তা একটি বিজয়ী শক্তির দেওয়া শর্তের মতো শোনায়: 'হয় আত্মসমর্পণ করো, নয়তো নির্বাসনে যাও'। এর সঙ্গে ১৩ নম্বর ধারায় হামাসসহ অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র করার কথা বলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের নিশ্চয়তা ছাড়া কোনো প্রতিরোধকারী গোষ্ঠীর কাছ থেকে নিরস্ত্রীকরণ দাবি করাটা অবাস্তব ও একপেশে। এটি ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ করার শেষ সম্বলটুকুও কেড়ে নিয়ে তাদের পুরোপুরি অরক্ষিত করে ফেলার একটি ষড়যন্ত্র।
শর্তাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র এক অধরা মরীচিকা: প্রস্তাবের ১৯ এবং ২০ নম্বর ধারায় ফিলিস্তিনের স্বশাসন ও রাষ্ট্র গঠনের 'গ্রহণযোগ্য পথের' কথা বলা হলেও তা বেশ কিছু কঠিন শর্তের বেড়াজালে আবদ্ধ। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সংস্কার, গাজার পুনর্গঠন এবং স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার মতো বিষয়গুলো পূরণ না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্র গঠনের আলোচনা শুরুই হবে না। সমালোচকরা এটিকে 'গাজর দেখিয়ে প্রলুব্ধ করার কৌশল' হিসেবে অভিহিত করেছেন। এই শর্তগুলো এতটাই অস্পষ্ট ও সময়সাপেক্ষ যে, তা বাস্তবায়ন করতে কয়েক দশক লেগে যেতে পারে, যা স্বাধীন রাষ্ট্রের ধারণাকে একটি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখার নামান্তর। অর্থনৈতিক উন্নয়ন সোনার খাঁচায় বন্দী করার নীলনকশা: ১০ ও ১১ নম্বর ধারায় গাজায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং ব্যাপক উন্নয়নের যে চিত্র আঁকা হয়েছে, তা আপাতদৃষ্টিতে আকর্ষণীয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা একে রাজনৈতিক অধিকার ও সার্বভৌমত্বের দাবিকে অর্থনৈতিক প্রলোভন দিয়ে চাপা দেওয়ার একটি পুরনো কৌশল হিসেবে দেখছেন। ফিলিস্তিনিদের রাজনৈতিক স্বাধীনতার পরিবর্তে যদি শুধু অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়, তবে তা হবে সোনার খাঁচায় বন্দী করার মতো। এর মাধ্যমে গাজার মানুষদের সংগ্রামের মূল স্পৃহা ভূমি ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে ভোঁতা করে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাহিনী কার স্বার্থে এই নিরাপত্তা: ১৫ নম্বর ধারায় একটি অস্থায়ী আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী - (ওঝঅঙ্ক) গঠনের কথা বলা হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্র ও তার আরব মিত্রদের নিয়ে গঠিত হবে। প্রশ্ন উঠছে, এই বাহিনী কতটা নিরপেক্ষ হবে? অনেক বিশেষজ্ঞ আশঙ্কা করছেন, এই বাহিনী মূলত ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজেই ব্যবহৃত হবে এবং গাজার ওপর চলমান অবরোধকে একটি আন্তর্জাতিক বৈধতা দেবে। এটি গাজাকে একটি উন্মুক্ত কারাগার থেকে নিয়ন্ত্রিত নিরাপত্তা অঞ্চলে পরিণত করবে মাত্র, কিন্তু সত্যিকারের মুক্তি দেবে না।
অসলোর চেয়েও ভয়াবহ পরিণতির আশঙ্কা: ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই প্রস্তাব অনিবার্যভাবেই নব্বইয়ের দশকের অসলো চুক্তির কথা মনে করিয়ে দেয়। অসলো চুক্তিও শান্তির আশা জাগিয়েছিল, কিন্তু ইসরায়েলের ক্রমাগত বসতি স্থাপন এবং চুক্তির শর্ত লঙ্ঘনের কারণে তা ব্যর্থ হয়। অনেক বিশ্লেষক আশঙ্কা করছেন, ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা অসলোর চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে। কারণ অসলোতে অন্তত ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব কর্তৃপক্ষের একটি কাঠামো ছিল, কিন্তু এই প্রস্তাবে সেই কাঠামোকেও একটি আন্তর্জাতিক বোর্ডের অধীনে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে, যা ফিলিস্তিনিদের জন্য আরও বেশি হতাশা এবং পরাধীনতা বয়ে আনবে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ দফা প্রস্তাব একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক দলিল। এটি একদিকে যেমন রক্তক্ষয়ী সংঘাত থামানোর একটি সুযোগ তৈরি করেছে, তেমনই অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং সার্বভৌমত্ব নিয়ে কঠিন প্রশ্ন তুলেছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বারবার বলছেন, তিনি কোনোভাবেই স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হতে দেবেন না। যদি তাই হয়, তাহলে ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যে চিরশান্তির এই প্রস্তাব কি ভিন্ন কিছু বহন করছে? এই প্রস্তাবনার বাস্তবায়ন গাজাবাসীর জন্য কতটা শান্তি বয়ে আনবে, নাকি তাদের আবাসভূমি ও সংগ্রামের অধিকার চিরতরে কেড়ে নেওয়ার একটি কৌশল-তা সময়ই বলে দেবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট