
সারা বিশ্বে তুমুল আলোচিত এক নাম—গ্রেটা থুনবার্গ। সুইডেনের এই কিশোরী আজ পরিবেশ আন্দোলনের এক সাহসী কণ্ঠস্বর এবং বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে তরুণদের আশার প্রতীক।
গ্রেটা থুনবার্গ ২০০৩ সালের ৩ জানুয়ারি সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার ছিল শিল্প ও সচেতনতার এক অনন্য মিশ্রণ। মা মালিনা এরনমান একজন খ্যাতনামা অপেরা গায়িকা, আর বাবা স্বান্তে থুনবার্গ একজন সুইডিশ অভিনেতা। ছোটবেলা থেকেই পরিবারে পরিবেশ ও সামাজিক দায়বদ্ধতার আলোচনা ছিল স্বাভাবিক বিষয়। সেই পরিবেশেই বেড়ে ওঠা গ্রেটার মনে প্রকৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা তৈরি হয়, যা পরবর্তীতে এক বৈশ্বিক আন্দোলনের জন্ম দেয়।
মাত্র ১১ বছর বয়সে গ্রেটার মধ্যে অ্যাসপার্জার সিন্ড্রোম (Asperger Syndrome) ধরা পড়ে—একটি অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার। কিন্তু এই বিষয়টি তাকে দুর্বল না করে বরং আরও শক্তিশালী করে তোলে। তিনি নিজেই বলেছেন, এই সিন্ড্রোম তাকে গভীর মনোযোগ দিতে সাহায্য করে, যা তার আন্দোলনের মূল শক্তি হয়ে দাঁড়ায়।
স্কুলজীবনে গ্রেটা জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে শুরু করেন এবং বুঝতে পারেন, পৃথিবীর ভবিষ্যৎ ভয়াবহ বিপদের মুখে। ২০১৮ সালে, মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে সুইডিশ পার্লামেন্টের সামনে বসে পড়েন হাতে একটি পোস্টার নিয়ে—“School Strike for Climate” (জলবায়ুর জন্য স্কুল ধর্মঘট)। তার এই একক প্রতিবাদ সারা বিশ্বে তরুণ সমাজের মাঝে ঢেউ তুলেছিল। এরপর থেকে ‘Fridays for Future’ নামে তার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ থেকে আমেরিকা, এশিয়া থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত।
গ্রেটা বর্তমানে তার শিক্ষাজীবন চালিয়ে যাচ্ছেন, পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন রোধ ও পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। তার সাহস, সততা ও দৃঢ় অবস্থান তাকে আধুনিক যুগের অন্যতম প্রভাবশালী তরুণ নেত্রীতে পরিণত করেছে।
সম্প্রতি তিনি আবারও বিশ্বজুড়ে আলোচনায় আসেন গাজাগামী ত্রাণবহর অভিযানে অংশ নিয়ে। মানবিক সহায়তা নিয়ে যাওয়া বহরটি ইসরায়েলি নৌবাহিনীর হামলার মুখে পড়ে। অভিযাত্রীদের ভাষ্যমতে, ইসরায়েলি সেনারা গ্রেটা থুনবার্গকে চুল ধরে টেনে নিয়ে যায়, মারধর করে এবং তাকে ইসরায়েলি পতাকা চুম্বন করতে বাধ্য করে। পরে সুইডিশ কর্মকর্তাদের কাছে গ্রেটা অভিযোগ করেন, বন্দিদশায় তার সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হয়। দ্য গার্ডিয়ানের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তিনি ডিহাইড্রেশনের শিকার হন, পর্যাপ্ত খাবার ও পানি পাননি এবং তার শরীরে ফুসকুড়ি দেখা দেয়, যা সম্ভবত কারাগারের বিছানার পোকামাকড়ের কারণে হয়েছিল।
এই ঘটনার পর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, যখন গ্রেটা বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তখন বিশ্বনেতারা তার পাশে দাঁড়াতে আগ্রহী ছিলেন; কিন্তু ইসরায়েলি হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠার পর সেইসব নেতাদের নীরবতা অত্যন্ত দুঃখজনক।
গ্রেটা থুনবার্গ এথেন্স বিমানবন্দরে পৌঁছে গণমাধ্যমের সামনে স্পষ্ট করে বলেন, “গাজায় একটি গণহত্যা চলছে, এবং বিশ্বব্যবস্থা ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। তারা এমনকি জঘন্য যুদ্ধাপরাধও ঠেকাতে পারছে না।”
পরিবেশ আন্দোলনের প্রতীক থেকে মানবতার কণ্ঠে রূপ নেওয়া গ্রেটা থুনবার্গ আজ কেবল জলবায়ুর লড়াই নয়, ন্যায়বিচার ও মানবিকতার এক বৈশ্বিক প্রতীক হয়ে উঠেছেন। তার কণ্ঠ এখনও তরুণ প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেয়—একজন মানুষও পরিবর্তনের সূচনা ঘটাতে পারে, যদি তার মধ্যে থাকে সত্যের প্রতি অটল বিশ্বাস ও সাহস।